ভারতসহ পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে করোনারি স্টেন্টের দাম বাংলাদেশের তুলনায় কম। সে কারণে হৃদরোগের চিকিৎসকেরা দাম কমাতে কয়েক মাস ধরে আলোচনা চালিয়ে আসছিলেন। তারা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে রিংয়ের দাম কমাতে চিঠি দিয়েছিলেন। সেই চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ওষুধ প্রশাশন অধিদপ্তর দাম কমাতে উদ্যোগ নেয়।
বিস্তারিতঃ হার্টের রিংয়ের দাম পুনর্নির্ধারণ করেছে ঔষধ প্রশাসন অধিদফতর। তারা বলছে, জনসাধারণের কথা বিবেচনা করে আগের চেয়ে দাম কমানো হয়েছে। নির্ধারিত এই দামের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি করলে সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ঔষধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩ অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে বেশি অর্থ নিলে অর্থদণ্ড ও কারাদণ্ডের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে।
প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ৪৫ হাজার কার্ডিয়াক স্টেন্ট ব্যবহার করা হয়। খবরটি হৃদরোগীদের জন্য স্বস্তির আশ্বাস মিলেছে। আগামী ১৬ ডিসেম্বর থেকে এই নতুন দাম কার্যকর হবে। একইসাথে হৃদরোগের চিকিৎসা প্রদানকারী সব হাসপাতালের নোটিশ বোর্ডে করোনারি স্টেন্টের মূল্যতালিকা প্রদর্শনের নির্দেশ দিয়েছে ডিজিডিএ।
অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ ইউসুফ সাক্ষরিত এক প্রজ্ঞাপনে গতকাল মঙ্গলবার বলা হয়, ঔষধ ও কসমেটিকস আইন ২০২৩ এর ৩০(১) ধারা অনুযায়ী, ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর করোনারি স্টেন্টের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য পুনরায় নির্ধারণ করা হলো। একইসাথে হৃদরোগের চিকিৎসা প্রদানকারী হাসপাতালগুলোকে স্টেন্টের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য প্যাকেজে অন্তর্ভুক্ত না করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, এখন থেকে স্টেন্টের নাম, সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) এবং উৎপাদনকারীর নাম উল্লেখসহ পৃথক ক্যাশ মেমো সরবরাহ করতে হবে। স্টেন্টের প্যাকেটের গায়ে উৎপাদন, মেয়াদ, উৎপাদনকারী দেশের নাম ও খুচরা মুল্য লেখা থাকতে হবে।
বিজ্ঞপ্তিতে হার্টের রিং আমদানিকারক ২৭টি প্রতিষ্ঠানের ৪০টির বেশি রিংয়ের নাম উল্লেখ করে আলাদা আলাদাভাবে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। রিংয়ের খুচরা দাম সর্বোচ্চ ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। আর সর্বনিম্ন দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪ হাজার টাকা।
বহুল ব্যবহৃত যেসব রিংয়ের দাম কমেছে সেগুলো হলো—পোল্যান্ডের অ্যালেক্স প্লাসের দাম ৬২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে কমে ৫৩ হাজার টাকায় নেমেছে। আয়ারল্যান্ডের জিয়েন্স প্রাইম ৭২,৫০০ টাকা থেকে কমে ৬৬,৬০০ টাকা হয়েছে। একই কোম্পানির জিয়েন্স এক্সপেন্ডিশন ১ লাখ ৮ হাজার ৬২৮ টাকা থেকে কমে হয়েছে ৯৩ হাজার ৫০০ টাকা এবং জিয়েন্স অ্যালপাইন ১ লাখ ৪৯ হাজার থেকে কমে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা।
জার্মানির জিলমুসের দাম ৬০ হাজার থেকে কমে হয়েছে ৫৩ হাজার টাকা। আয়ারল্যান্ডের মেডট্রোনিকের রেজোলুটে ওনিক্সের দাম ১ লাখ ৪৩ হাজার টাকা থেকে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকা। আমেরিকার বোস্টন সায়েন্টেফিকের প্রোমুস প্রিমিয়ারের দাম ৭৫ হাজার থেকে কমে হয়েছে ৭৩ হাজার টাকা, প্রোমুস এলিটের দাম ১ লাখ ১২ হাজার থেকে কমে হয়েছে ৯৩ হাজার টাকা এবং একই কোম্পানির সিনার্জি ব্র্যান্ডের রিংয়ের দাম ১ লাখ ৫২ হাজার টাকা থেকে কমে হয়েছে ১ লাখ ৪০ হাজার ৫০০ টাকা।
সুইজারল্যান্ডের বায়োম্যাট্রিক্স নেওফ্লিক্সের দাম ৬২ হাজার ৫০০ টাকা থেকে কমে হয়েছে ৫৮ হাজার টাকা। একই কোম্পানির বায়োম্যাট্রিক্স আলফা ৮৬ হাজার টাকা থেকে কমে হয়েছে ৬৫ হাজার টাকা। নেদারল্যান্ডসের অ্যালবুমিনাস ডিইএস প্লাসের দাম ৭২ হাজার টাকা থেকে কমে হয়েছে ৫৪ হাজার টাকা।
সুইজারল্যান্ডের বায়োফ্রিডম ৬৫ হাজার, প্রি-কিনেটিক ১৫ হাজার টাকা, আইট্রিক্স ৩৬ হাজার টাকা, ওসিরা মিশন ৬৫ হাজার টাকা, আয়ারল্যান্ডের ডিইএসওয়াইএনসি ৫৫ হাজার, সুপরাফ্ল্যাক্স ৫৩ হাজার, জাপানের আল্টিম্যাস্টার ৬০ হাজার, স্পেনের এনজিওলাইট ৫৩ হাজার, আইভাসকুলার এনজিওলাইট ৫৩ হাজার টাকা, আইএইটি ডেস্টিনি ৫৩ হাজার টাকা, নেদারল্যান্ডের কম্বো প্লাস ৫৩ হাজার টাকা, ভারতের বায়োমিমে ৪০ হাজার টাকা, এভারমাইন-৫০ ৪০ হাজার টাকা।
এছাড়া, মেটাফর ৩৫ হাজার টাকা, জার্মানির সিসি ফ্লাক্সে ১৫ হাজার টাকা, ইকা লিমুস ৫৩ হাজার টাকা, ইউকোন চয়েস পিসি ৫৩ হাজার টাকা, অর্থস পিকো ১৫ হাজার টাকা, আবিরস ৫৩ হাজার টাকা, করোফ্লিক্স আইএসআইআর ৫৩ হাজার টাকা, ম্যাগমা ৩৭ হাজার টাকা এবং সুনা স্ট্যান্ট ১৪ হাজার টাকা, যুক্তরাষ্ট্রের কোবাল্ট ক্রোমিয়াম ৫৫ হাজার টাকা, ডিরেক্ট স্ট্যান্ট সিরো ৫৫ হাজার টাকা, ডিরেক্ট স্ট্যান্ট ২০ হাজার টাকা, দক্ষিণ কোরিয়ার জিনোস ডিইএস ৪৫ হাজার টাকা, ইতালির অ্যাভেন্টগার্ড ১৫ হাজার টাকা, সিআরই-৮ ৫৩ হাজার টাকা, পোল্যান্ডের অ্যালেক্স ৫৩ হাজার টাকা, ফ্রান্সের এ্যামাজোনিয়া ৫৩ হাজার টাকা নির্ধারিত হয়েছে।
তথ্য বলছে, প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে প্রায় ৪৫ হাজার কার্ডিয়াক স্টেন্ট ব্যবহার করা হয়।
নতুন দামে উপকৃত হবে সাধারণ রোগীরা
চলতি বছরের গত ১১ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর একটি হাসপাতালে বেসরকারি চাকরিজীবী আসাদুজ্জামানের হার্টে দুটি রিং পরানো হয়। একেকটি রিংয়ে তার খরচ পড়ে দেড় লাখ টাকা করে। সার্জারি ও হাসপাতালে ভর্তিসহ সব মিলিয়ে চিকিৎসায় তার খরচ হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, স্টেন্টের দাম কমানোয় এখন সাধারণ রোগীরা উপকৃত হবে।
গত সেপ্টেম্বরে স্টেন্টের নতুন দাম নির্ধারণের কথা থাকলেও তা করা হচ্ছে এ মাসে। এ বিলম্বের কারণ জানতে চাইলে মোহাম্মদ ইউসুফ বলেন, ‘উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলোর স্টক শেষ না হওয়ায় তারা নতুন দামে বিক্রি করতে রাজি হচ্ছিল না। এছাড়া ইউরোপীয় স্টেন্টগুলোর দাম কমাতে চাচ্ছিলেন না ব্যবসায়ীরা। কয়েক দফা আলোচনার পর তাদের রাজি করানো সম্ভব হয়েছে।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক করোনারি স্টেন্ট সরবরাহকারী একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, ‘ডলারের দাম বেড়েছে, ব্যাংকে এলসি খুলতে জটিলতা দেখা দিয়েছে। তবুও স্টেন্টের দাম কমিয়েছে সরকার। এতে আমদানি জটিলতা বাড়বে। আমরা ব্যবসা করি কিছু মুনাফার জন্য। এ দামে স্টেন্ট দিলে আমাদের কিছুই থাকবে না। তবুও সরকারের আদেশ মানতে হবে।’
ডলার সংকটের এই সময় ব্যবসায়ীরা কম দামে স্টেন্ট বিক্রি করতে রাজি হবে কি না জানতে চাইলে অধিদপ্তরের মুখপাত্র ও উপ-পরিচালক নুরুল আলম বলেন, ‘আমাদের দেশে স্টেন্ট উৎপাদন করা হয় না, আমদানি করে প্রতিষ্ঠানগুলো। মার্কেটে এখন অনেক বেশি কম্পিটিটর আছে। যারা কম দামে বিক্রি করতে রাজি হবে, আমরা তাদের আমদানির অনুমোদন দেব।’
ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব কার্ডিওভাসকুলার ডিজিজের পরিচালক অধ্যাপক মীর জামাল উদ্দিন বলেন, ‘অবশেষে ডিজিডিএ স্টেন্টের দাম কমাতে সক্ষম হয়েছে। এটি একটি ভালো উদ্যোগ। এতে সাধারণ রোগীরা উপকৃত হবে।’
নির্দেশনা না মানলে জেল-জরিমানা
নুরুল আলম বলেন, কোনো প্রতিষ্ঠান বা হাসপাতাল যদি বেশি দামে স্টেন্ট বিক্রি করে, তাহলে ওষুধ ও কসমেটিক আইন অনুযায়ী দুই বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা দুই লাখ টাকা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবে। আমরা আশা করছি হৃদরোগীরা এখন থেকে কম খরচে চিকিৎসা পাবে।