আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতির মধ্যে ‘মিনিমালি ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারি’ বা এমআইএসএস এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। এই পদ্ধতিটি রোগীদের জন্য একদিকে যেমন দ্রুত নিরাময় নিশ্চিত করে, তেমনি অপারেশনের জটিলতা কমায় বলে মন্তব্য করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
শুক্রবার (৬ ডিসেম্বর) ঢাকা মেডিকেল কলেজে (ঢামেক) ‘নিউরো স্পাইন সোসাইটি অব বাংলাদেশ’ এর আয়োজনে ‘মিনিমালি ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারি এন্ড ক্যাডাভেরিক ওয়ার্কশপ’ শীর্ষক দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তারা এই কথা বলেন।
ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের নিউরোসার্জারি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটি চেয়ারম্যান ডা. মো. জাহিদ রায়হানের সঞ্চালনায় অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের (ঢামেক) অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল আলম।
এছাড়াও অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন হাসপাতাল পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. আসাদুজ্জামান, কলেজের উপাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. ফারুক আহাম্মদ, ফরেনসিক মেডিসিন বিভাগের বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ডা. কাজী গোলাম মোখলেছুর রহমান ও অ্যানাটমি বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ডা. এ এইচ এম মোস্তফা কামাল।
কর্মশালার প্রথম দিনে অ্যাকাডেমিক সেশনে ‘ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাকাল্টি’ হিসেবে ছিলেন মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডা. দিনেশ কুমারান, সিঙ্গাপুরের ট্যান টক সেং হাসপাতালের সহকারী অধ্যাপক ডা. মার্ক ট্যান ও কনসালটেন্ট ডা. ওয়াইনে ইয়াপ। এই কর্মশালায় দেড় শতাধিক চিকিৎসক অংশগ্রহণ করেন।
মিনিম্যালি ইনভেসিভ সার্জারিকে সময়ের দাবি উল্লেখ করে অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মো. কামরুল আলম বলেন, প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ ছাড়া একজন ডাক্তার সম্পূর্ণভাবে সার্জন হয়ে উঠতে পারে না। নিরাপদ সার্জারির জন্য বেশি বেশি প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। এই ধরনের আয়োজনের জন্য আয়োজকদের ধন্যবাদ জানিয়ে ঢামেকের অ্যানাটমি বিভাগ সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে বলেও জানান তিনি।
তিনি বলেন, সেসব মৃত ব্যক্তির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, যাদের মৃতদেহ ব্যবহার করা হচ্ছে। একইসাথে তাদের আত্মার শান্তি কামনা করছি।
ঢামেক পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ডা. আসাদুজ্জামান বলেন, ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নিউরোসার্জারি ডিপার্টমেন্টে সারাদেশ থেকে প্রচুর রোগী আসে। এদের বড় একটি অংশের স্পাইন সার্জারি করতে হয়। এই কর্মশালা চিকিৎসকদের দক্ষতা উন্নয়নে আমাদের সহযোগিতা করবে।
অনুষ্ঠানে বক্তারা আরও বলেন, বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই মেরুদণ্ডের (স্পাইন) রোগ একটি অন্যতম স্বাস্থ্য সমস্যা । বাংলাদেশে মেরুদণ্ডের রোগের প্রাদুর্ভাব ক্রমবর্ধমান। এর মধ্যে বয়স্ক মানুষের পাশাপাশি তরুণদেরও মেরুদণ্ড সংক্রান্ত সমস্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। মেরুদণ্ডের অপারেশন নিউরোসার্জনরা সবসময়ই করে আসছে। পূর্বে বড় করে কেটে করা হতো কিন্তু বর্তমানে ‘মিনিমালি ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারি’ বাংলাদেশে চলমান।
একটি পরিসংখ্যানের বরাতে এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশে প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে প্রায় ৪০-৫০ শতাংশ লোক মেরুদণ্ডের ব্যাথা বা সমস্যায় ভুগছেন। মেরুদণ্ডের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ডিস্কের সমস্যা, স্নায়ু চেপে যাওয়া ইত্যাদি অত্যন্ত সাধারণ। ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সী ৬০-৭০ শতাংশ লোক মেরুদণ্ডের সমস্যায় ভুগছেন। এক গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ১০-১৫ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ ডিস্কের সমস্যায় আক্রান্ত হন। ব্যাক পেইন বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে সাধারণ মেরুদণ্ড রোগগুলোর মধ্যে একটি। এতে শ্রমজীবী মানুষ, গাড়িচালক, বসে কাজ করা অফিসকর্মীরা বেশি আক্রান্ত হন বলেও জানান বক্তারা।
‘মিনিমালি ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারি’র প্রক্রিয়া বর্ণনা করে ডাক্তাররা বলেন, এটি হল একটি অত্যাধুনিক স্পাইন সার্জারি পদ্ধতি যেখানে ছোট কাটা দিয়ে স্পাইন অপারেশন করা হয়। এতে রোগী কম ব্যাথা অনুভব করেন এবং হাসপাতাল থেকে দ্রুত ছুটি নিতে পারেন। এই পদ্ধতিতে সাধারণত লেজার, ছোট ক্যামেরা এবং বিশেষ যন্ত্র ব্যবহার করা হয়, যা অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে মেরুদণ্ডের সমস্যাগুলোর সমাধান করে।
এসময় মিনিমালি ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারির বেশ কিছু সুবিধার কথা তুলে ধরা হয়। সুবিধাগুলো হলো- ছোট কাটা হওয়ায় রোগীর শারীরিক আঘাত কম হয়; দীর্ঘদিন বিছানায় পড়ে থাকতে হয় না, ফলে কর্মক্ষেত্রে ফিরতে সময় লাগে কম; পুরনো পদ্ধতির তুলনায় ব্যাথা ও রক্তক্ষরণ কম হয়; ছোট কাটা এবং আধুনিক যন্ত্র ব্যবহার হওয়ায় ইনফেকশনের সম্ভাবনা অনেক কম।
এ বিষয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজক কমিটি চেয়ারম্যান ডা. মো. জাহিদ রায়হান বলেন, নিয়মিত প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশের জনগণকে ‘মিনিমালি ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারি’র সুযোগ পাইয়ে দেয়ার জন্যই এই কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। ‘মিনিমালি ইনভেসিভ স্পাইন সার্জারি’ একটি ভরসাযোগ্য ও আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি যা রোগীদের জীবনযাত্রাকে আরও সহজ ও সুন্দর করে তুলতে পারে।