আমাদের রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ মাপার যন্ত্রের নাম পালস অক্সিমিটার। কোভিড ১৯ মহামারির শুরু থেকেই এই যন্ত্রটির ব্যবহার বেড়েছে কয়েক গুণ। যে-কোনো কোভিড রোগীর শারীরিক অবস্থা নির্ণয়ের জন্য এবং সময়মতো সঠিক চিকিৎসা দেওয়ার জন্য পালস অক্সিমিটারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। কিন্তু যে-কোনো যন্ত্রের মতো এটাও সঠিক নিয়মে ব্যবহার না করলে সঠিক রিডিং দেবে না। যা কোভিড রোগীর জন্য বিপদের কারণ হতে পারে। এই কারণেই কীভাবে পালস অক্সিমিটার সঠিকভাবে ব্যবহার করতে হয় তা জেনে নেওয়া জরুরি।
পালস অক্সিমিটার ব্যবহারের সঠিক উপায়:
১. আপনার হাতটি যেন রিল্যাক্স, উষ্ণ এবং হৃৎপিণ্ডের ঠিক নিচে থাকে সেটা নিশ্চিত করুন৷
২। পালস অক্সিমিটার আলোর সাহায্যে আমাদের রক্তের অক্সিজেন লেভেল নির্ণয় করে। তাই সরাসরি আলো পড়ে এমন কোথাও পালস অক্সিমিটার ব্যবহার করলে সঠিক রিডিং নাও দিতে পারে।
২. আপনি হাতের যে আঙুলে পরীক্ষাটি করতে চান, সেই হাতের আঙুলের নখে যদি নেইলপলিশ লাগানো থাকে তাহলে ‘নেইলপলিশ রিমুভার’ দিয়ে সেটা উঠিয়ে ফেলুন৷
৩. আপনি যে কোম্পানির ডিভাইস কিনবেন, ডিভাইসের সাথেই একটি নির্দেশিকা পাবেন৷ যন্ত্র ব্যবহারের আগে নির্দেশিকা দেখে নিন।
৪. একটি স্থির রিডিং পাওয়ার জন্য কমপক্ষে ২ মিনিট অপেক্ষা করুন৷
৫. আপনার পাওয়া রিডিংকে প্রতিনিয়ত সময় ও তারিখসহ কোনো কাগজ বা অন্য কোথাও টুকে রাখুন যেন আপনার পাওয়া রিডিংগুলো দেখে ডাক্তার তার পরবর্তী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন৷
রিডিং ৮৯% এর নিচে চলে গেলে সেটা আপনার হৃৎপিণ্ড কিংবা ফুসফুসের কোনো অসুস্থতাকে নির্দেশ করতে পারে৷ প্রতিনিয়ত ৮৯% এর নিচে রিডিং পাওয়া একটি সম্ভাব্য স্বাস্থ্যঝুঁকি । তাই এই অবস্থায় ডাক্তারের সহায়তা নেওয়া জরুরি৷
যে বিষয়গুলো আপনার যথাযথ রিডিং পাওয়াকে বাঁধাগ্রস্থ করতে পারে:
১. নেইলপলিশ
২. সরাসরি আসা তীব্র আলো
২. অপরিষ্কার নখ
৩. সিগারেটের ব্যবহার
৫. ত্বকের ঘণত্ব।
৬. ত্বকের তাপমাত্রা ।
৮. দেহে সংবহনরত রক্তের গতি কম থাকলে৷
তথ্যসূত্র – https://www.webmd.com/lung/pulse-oximetry-test
পালস অক্সিমিটার ও প্যানিক অ্যাটাক
অ-ডাক্তার হয়ে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা মাপতে বসলে, দুর্বল মনের মানুষের প্যানিক অ্যাটাক হতেই পারে। হিসেব অনুযায়ী রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫ বা তার উপরে থাকলে চিন্তা নেই। কিন্তু পালস অক্সিমিটার যে ১০০ শতাংশ অভ্রান্ত, এমন তো নয়। সে যা রিডিং দেয়, বাস্তবে রক্তে অক্সিজেনের মাত্রা তার চেয়ে ২ কম বা বেশি হতে পারে। মানে ৯৭ রিডিং হলে স্যাচুরেশন ৯৫ থেকে ৯৯-এর মধ্যে আছে। সুতরাং কেউ যদি বলে, ৯৪-এর কম হলেই কেস খারাপ আর রিডিং যদি আসে ৯৩, আপনার কেস খারাপ নাও হতে পারে। কিন্তু আপনি তো সেটা জানেন না। কাজেই আপনার টেনশন কে আটকাবে?
কেন এমন হয়? হতেই পারে। যন্ত্র বলে কথা। তার উপর সে মাপে স্রেফ রং। রক্তে যখন অক্সিজেনের পরিমাণ কমে আসে, তার রঙের পরিবর্তন হয়। রক্তে ১০০ শতাংশ অক্সিজেন থাকলে তার রং হয় টকটকে লাল। অক্সিজেন কমতে থাকলে এই লালিমা বদলে যায়। পাল্স অক্সিমিটার মাপে ওই লালিমা। এবার, আপনি যদি আঙুলে লাল রং লাগিয়ে থাকেন, স্বাভাবিকভাবেই রিডিং বেশি আসবে। কারণ সে তো আর জানে না, এটা রক্তের রং না নেল পালিশের রং। তাকে রং মাপতে বলা হয়েছে, সে রং মেপেছে। ব্যাস। তাতে আপনার বিপদ বাড়তে পারে।
অর্থাৎ, শুধু রিডিং মেপে আপনি ভাল আছেন না মন্দ, তা আপনার বোঝা সম্ভব নয়। লাভের লাভ, কম রিডিং এলে ও দুর্বল মনের মানুষ হলে প্যানিক অ্যাটাকের আশঙ্কা। কাজেই এই সব মাপামাপির ব্যাপার চিকিৎসকের উপর ছেড়ে দিয়ে নিজে নির্ভাবনায় থাকাই সবচেয়ে ভাল পন্থা।
১০-২০ শতাংশের সত্যি বিপদ, তাঁরা কী করবেন ?
“সেখানেই বা আপনি নিজে অক্সিজেন মেপে কী করবেন? কমে গেলে তো সেই হাসপাতালেই যেতে হবে। অক্সিজেন স্যাচুরেশন ৯৫-এর নীচে নেমে যাওয়ার পর যদি হাসপাতালের দোরে দোরে ঘুরতে হয়, ব্যাপারটা যথেষ্ট বিপজ্জনক। কারণ শ্বাসকষ্ট হচ্ছে মানে রোগ প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায় পার করে তৃতীয় পর্যায়ে ঢুকে পড়েছে। এই অবস্থা থেকে সুস্থ হয়ে ওঠা এমনিই মুখের কথা নয়। তার উপর যদি আবার চিকিৎসা শুরু হতে দেরি হয়!” জানালেন অমিতাভ নন্দী।
এখানে একটু দ্বিমত পোষণ করেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ । তাঁর মতে, “স্বাভাবিক অবস্থায় ঘরে বসে নিজেই নিজের অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপাটা যদিও কোনও কাজের কথা নয়, কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, যখন মহামারি নিয়ন্ত্রণ বলতে গেলে আমাদের হাতের বাইরে চলে গেছে, প্রথম পর্যায়ে রোগ ধরে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা যখন আকাশ-কুসুম কল্পনা মাত্র, এমনকি, দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগ ধরার মতোও পরিস্থিতি নেই, পালস অক্সিমিটার তখন কিছুটা হলেও জীবনদায়ী হতে পারে। বয়স্ক ও কো-মর্বিডিটি থাকলে ঘরে পাল্স অক্সিমিটার রাখলে কোনও ক্ষতি নেই, বরং ভাল।”
তা হলে কী করবে মানুষ?
“এখানে ব্যক্তি মানুষের যেমন ভূমিকা আছে, ভূমিকা আছে সরকারেরও”, । “যে কোনও মূল্যে রোগ ধরতে হবে প্রথম পর্যায়ে। অর্থাৎ যখন উপসর্গ হয়নি বা খুব মৃদু উপসর্গ হয়েছে, যাতে তখনই চিকিৎসক সিদ্ধান্ত নিতে পারেন, কাকে হাসপাতালে কড়া নজরদারিতে রাখতে হবে আর কে বাড়িতে বা কোয়রান্টিন সেন্টারে একটু শুয়ে থেকে বা দু-চারটে ওষুধ খেয়েই সুস্থ হয়ে যাবেন। এঁদের মধ্যেও দু-চারজনের পরে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। তবে প্রথম থেকে কড়া নজরদারিতে থাকলে সেই সংখ্যা অনেক কমে যায়। কমে রোগের জটিলতাও। মহামারিকে বশে আনার এটাই একমাত্র রাস্তা। ভেবে দেখুন, প্রথম পর্যায়ে রোগ ধরা পড়লে মানুষকে আলাদা করে দেওয়া হয় বলে একদিকে যেমন রোগ কম ছড়ায়, অন্য দিকে কড়া নজরদারি চলে বলে রোগ দ্বিতীয় পর্যায়ে (যখন জ্বর-কাশি বাড়ছে বা হালকা চাপ ধরছে বুকে) বা তৃতীয় পর্যায়ে (যখন শ্বাসকষ্ট শুরু হয়ে গেছে) যেতে পারে না খুব একটা। ফলে রোগীর টাকা বাঁচে। হাসপাতালে বেডের আকাল হয় না।”
“সাধারণ মানুষের কাছে আমার অনুরোধ”, বললেন সুবর্ণবাবু, “একটু জ্বর এসেছে মানে বৃষ্টিতে ভিজেছি, একটু কাশি হয়েছে মানে ঠান্ডা খেয়েছি, এসব অছিলায় নিজেকে না ভুলিয়ে, ডাক্তার দেখান। উপসর্গ কমে গেলেও দেখান।
তিনি বললেন, পরীক্ষা করিয়ে নিন। মনে রাখবেন, মহামারির সময় এই ধরনের যে কোনও উপসর্গ হলে আগে কোভিডের কথাই ভাবতে হবে। এটাই নিয়ম। প্রতিবেশী কী ভাববে, তা নিয়ে ভাবতে বসবেন না। কারণ রোগ যে হারে বাড়ছে, কালক্রমে তা ঘরে ঘরে ঢুকে যাবে। তখন কেউ আর কিছু ভাবার অবকাশ পাবেন না। আর এই ভয়ে রোগ নিয়ে বসে থাকলে, বাড়িতে সবার ছড়াবে। ছড়াবে আশপাশে। কারও কারও বাড়াবাড়ি হবে। মরতে হবে ধনে-প্রাণে।”
অমিতাভ নন্দী বলেন, “সরকারের কাছে আমার অনুরোধ পুলিশ পাঠিয়ে পালস অক্সিমিটারের ট্রেনিং না দিয়ে, সবাইকে ধরে ধরে পরীক্ষা করান। সবার হাতে পালস অক্সিমিটার ধরিয়ে দেওয়ার অর্থ হল, সরকার মেনে নিচ্ছেন, মহামারি নিয়ন্ত্রণের যে প্রাথমিক শর্ত, রোগকে প্রথম পর্যায়ে আটকে ফেলা, তা করতে তাঁরা অপারগ। তা ছাড়া, সরকারি স্বাস্থ্য পরিকাঠামো তো এমন নয় যে সব তৃতীয় পর্যায়ের রোগীকে চিকিৎসা দিতে পারবে! বেসরকারি হাসপাতালের খরচ সামলানো সাধারণ মানুষের কাজ নয়। যাঁদের হাতে টাকা আছে, তাঁরাও বেড পাচ্ছেন না। কাজেই পাল্স অক্সিমিটার দিয়ে অক্সিজেন মেপে তার পর হাসপাতাল খুঁজতে বেরোনো ভুল পন্থা। মহামারি যদি নিয়ন্ত্রণ করতে চান, সঠিক পথে এগোন।”